বেড়েছে পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা,কেন এই বর্বরতা!

গুজব বা জনমনে ক্ষোভের উদ্রেকের কারণে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। তবুও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কখনও বিগত সরকারের কর্মী-সমর্থক সন্দেহে কখনও বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আবার কখনও চুরির সন্দেহে এসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে যেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

 

সবশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে গণপিটুনির ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণপিটুনির ঘটনায় হতাহত হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।  বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানাযায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর পোড়ানো, আদালত চত্বরে তাদের চড়-থাপ্পড়, ডিম-জুতা নিক্ষেপসহ বহুমাত্রিক ‘মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেই চলছে । যা ইদানিং কালের আগে আর কখনও দেখেনি এ প্রজন্ম। এ থেকেই প্রমানিত হয় যে, দেশে বেড়েছে পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গণপিটুনি যেন এই সময়ে এ দেশে অনেকটা ডাল-ভাতের মতো একটা ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে। চলতি পথে ‘ধর ধর, মার মার’ চিৎকার কানে এলেই হলো, অমনি উত্তেজিত জনতা পঙ্গপালের মতো হুমড়ি খেয়ে চড়াও হয় নিরস্ত্র লোকটির ওপর। সঙ্গে শুরু হয় চড়-কিল-ঘুসির মাধ্যমে দোষি বা নির্দোষ লোকটির বিচার বা ‘জাস্টিস’। শুরু হয় আয়েশ আর খায়েশভরা উত্তম-মধ্যম।

 

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার স্থির চিত্র ও ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করা হচ্ছে অবলিলায়। সেখানে নিষ্ঠুরতা এতটাই ফুটে উঠেছে যে, যা দেখার মত নয়। সে সব নির্মমতা দেখে গাঁ শিউরে ওঠে সবার। অথচ তাদের আচার আচরন দেখে মনে হয়  গণপিটুনির মতো ভয়ংকর আক্রমণ যেন উৎসবে রূপ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেনইবা বেড়ে গেল এই ধরনের পৈচাশিক প্রবণতা ? কেনই  বা এই বর্বরতা? তা নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। এগিয়ে আসছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরাও। তাহলে বৈষম্য বিরোধি আন্দোলন পরবর্তিত এই পরিস্থিতিতে দেশটা কি মগের মূল্লুুকে পরিনত হল নাকি ? জনমনে এমন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। আগে ছেলেধরা, চোর-ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহেই মূলত ঘটত গণপিটুনির ঘটনা।

 

আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা যে,২০১৯ সালের ২০শে জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাসলিমা বেগম রেণু নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা বেশ আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত ওই হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, পুলিশের দুর্বলতা এবং তদন্তে ঘাটতির কারণে এসব গণপিটুনি থামানো যাচ্ছে না।

 

হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন এর শিকার হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা তাদের অনুরাগীরা। এখন হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে কোথাও ‘লীগ’ পেলেই হলো,সে যে ‘লীগ’ই হোক না কেন! অমনি রামধোলাই। এমনকি সীমান্তে, আদালত চত্বরে পুলিশ পরিবেষ্টিত থাকাবস্থায়ও অনেকে এমন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। কোথাও ‘ছাত্রলীগ’ দেখলেই হলো, ছাত্র-জনতা সঙ্গে সঙ্গে খুনে মেজাজে হয়ে যাচ্ছে। দেশের পরবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এতে ঝরছে বহু তাজা প্রাণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ‘মব কালচার’। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে এমন অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্গঠন না হওয়ায় দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা করছে। গত ১৫/১৬ বছর মানুষ স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের দ্বারা নানাভাবে নিপীড়িত হয়েছিল। এতে সব ধরনের মানুষদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জমা ছিল। ৫ই অগাস্টের পরবর্তী সময়ে মব জাস্টিসের মতো নানা সহিংসতার মাধ্যমে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং এখন জরুরী হলো জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যেন স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি না হয়। পাশাপাশি সর্বস্তরের নাগরিকদেরও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নচেৎ এ ধরনের অপকর্ম প্রতিরোধ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত হন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ৫১ জন। আর চলতি বছরের  জানুয়ারি-জুলাই এই ৭ মাসেই গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৩ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ১৬, খুলনায় ২, রাজশাহীতে ৭, সিলেটে ১, চট্টগ্রামে ৩, বরিশালে ১ ও ময়মনসিংহে ৩ জন নিহত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানাযায়, সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যার প্রবণতা বেড়েছে। গত সপ্তাহের বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে মোবাইল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোচনার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলে। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করেন কিছু শিক্ষার্থী। এছাড়া ১০ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে এক আইনজীবীকে, ৪ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে একজনকে, ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ে এক বিএনপি নেতাকে, ৪ সেপ্টেম্বর খুলনার খানজাহান আলী এলাকায় একজনকে, ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে, ১৪ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের রাজৈরে একজনকে, ১৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুরে একজনকে, ৮ আগস্ট বগুড়ার ধুনটে এক যুবলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।  তাদের কাউকে চোর সন্দেহে, কাউকে স্বৈরাচারের দোসর সন্দেহে আবার কারও প্রতি ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

 

তবে অতি সম্প্রতি অর্থাৎ গতসপ্তাহের বুধবার দেশের দুই সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে দুটি হত্যাকান্ড দেশবাসীকে বিমূঢ় করে তুলেছে। এ ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতি বিস্ময়ে ফেটে পড়েছে যেন। সবাই বলছে, এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয়! এ কেমন ছাত্র সমাজ? বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একটা গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে, দেশের ছাত্র সমাজের অগ্রবর্তী অংশই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে থাকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে বুধবার রাতে যেভাবে সংঘবদ্ধ অপশক্তির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। চোর সন্দেহে তিন দফায় তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কয়েক বছরের ব্যবধানে এই যুবকের মা, বাবা ও ভাই মৃত্যুবরণ করলে তিনি হয়ে পড়েছিলেন নিঃসঙ্গ। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ক্ষুধার পেট নিয়ে ঘুরতেন রাস্তায় রাস্তায়। বুধবারও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন কিছুটা অন্ন জোগাতেই হয়তো। চোর সন্দেহে তাকে আটক করা হয় এবং নিষ্ঠুরতার এক চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাকে মেরে ফেলার আগে খেতে দেওয়া হয় ভাত। ওদিকে একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ গণপিটুনির শিকার হয়ে ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে। আন্দোলনরত ছাত্র সমাজের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে হত্যা করা হয়। বলা বাহুল্য, ওপরের দুটি ঘটনাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। ঘটনা দুটি নিঃসন্দেহে সামগ্রিকভাবে ছাত্র সমাজের ভাবমূর্তিতে লেপন করেছে কলঙ্ক। আমরা গভীরভাবে লক্ষ করছি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার দেড় মাস পরও দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র সমন্বয়কদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্বে অবহেলা করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র জাতি ।

দেশবাসী কারোরই অজানার কথা নয় যে,দেশে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় নেই। প্রায় নিস্ক্রিয় পুলিশের বিকল্প হিসাবে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে। আমরা মনে করি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও অন্যান্য নৈরাজ্য ঠেকাতে জনগণের উচিত সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। আমরা এও জানি যে, আইনে যৌথ দায়িত্বশীলতা  বলে একটা নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন, যেন অপরাধটি তিনি একাই করেছেন। গণপিটুনিতে কোনো অপরাধী যদি মারা যায়, তজ্জন্য সবাইকে সমভাবে দায়ী করা যাবে। অবশ্য গণপিটুনিদানের জন্য বা গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ার জন্য কারও সাজা হয়েছে, এমন নজির আমাদের দেশে নেই। অথচ কাজটি বেআইনি তো বটেই, সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ দন্ডনীয় অপরাধ।   প্রকৃতপক্ষে গণপিটুনি ব্যাপারটি কেবল অমানবিকই নয়, সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধও বটে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

 

কিন্তু অবস্থা তো যে লাউ সেই কদু! কে শোনে কার কথা? আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এসব কি তবে কেবল গালভরা ‘ফাঁকা বুলি’? অবশ্য আইন উপদেষ্টা বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বলতেই হবে, সরকারের আর নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে সরকার জনপ্রিয়তা হারাবে বৈকি।

 

সাংবাদিক ও কলাম লেখক মো.ইউসুফ আলী

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *