শিক্ষা সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

 

 

 

দিন বদলের বইছে হাওয়া, শিক্ষা মোদের প্রথম চাওয়া। এ শ্লোগানে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই একমত। কিন্তু এ দেশের রাজণীতির যাতাকলে পরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। সদ্য পতিত সরকার নিজের ক্ষমতা ও গদি পাকা পোক্ত করতে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এনেছিল ব্যাপক পরিবর্তন। এক কথায় শিক্ষা পদ্ধতিকেই পাল্টে দিতে চেয়েছিল তৎকালিন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিষ্ট সরকার।

 

জানা যায়, আমাদের শিক্ষাণীতিতে সৃজনশীল নামে কিম্ভূত এক পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, যাতে উপকার কী হয়েছে  তা আমাদের জানা নেই,তবে অপকার যে হয়েছে তা অনস্বীকার্য। তারপরও শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই। এটাই যে শেষ পদক্ষেপ, তা নিশ্চয়ই নয়। সুতরাং আমাদের ছাত্র-জনতার বৈষম্য বিরোধি আন্দোলনে স্বৈর-শাসকের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে হাত দিয়েছেন। সেখানে শিক্ষা সংস্কারে জরুরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন দেশের গুণী শিক্ষাবিদগণ। তাদের মতে শিক্ষা সংস্কার রাষ্ট্র সংস্কারেরই অংশ।

 

আমরা জানি শিক্ষা হল জ্ঞান লাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হল শিক্ষা। তবে যুগে যুগে নানা মনীষী নানাভাবে শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবার সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা মানে হল মৌলিক শিক্ষা। আর কথায় বলে, “শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি অশিক্ষিত জাতিও বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে ঠাঁই করে নিতে পারে না। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বিশ্লে¬ষণ করলে আমরা দেখব শিক্ষা জাতির মেরুদন্ডের চেয়েও বেশি কিছু। কারণ মেরুদন্ডহীন প্রাণী সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারলেও চলাচল করতে পারে। কিন্তু বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে, তথ্য-প্রযুক্তির এই দিনে অশিক্ষিত কোন জাতির পক্ষে টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই সর্বস্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়াই এখন অপরিহার্য। সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের এই সময়ে সবার আগে সংস্কারের প্রয়োজন শিক্ষা। এমনটাই ভাবছেন সচেতন মহল।

 

আমরা যখন আমাদের শৈশবকালিণ শিক্ষা পদ্ধতি এবং বর্তমান সময়ের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে রকথা বলছিলাম তখন অনেকেই আবার বলে উঠছেন যে, শিক্ষা যেহেতু জ্ঞান লাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া সতরাং সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার সংজ্ঞা বা ধারণা ও পদ্ধতিতে পরির্বতন এসেছে। এটাও একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই বটে। যেমন,বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে লাতিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে। যার অর্থ বের করে আনা। অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। সক্রেটিসের ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।” এরিস্টটল বলেন “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “শিক্ষা হল তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকেও গড়ে তোলে। তবে আধুনিক চিন্তাবিদ এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন শিক্ষা এক ধরনের গতিশীল কাজ। যা মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে। অনেক সময় জ্ঞানার্জনকে স্বাভাবিক ভাবে শিক্ষা বলা হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি যত জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁকেই আমরা তত শিক্ষিত বলি। সংকীর্ণ অর্থে বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান বা কৌশলকে শিক্ষা বলা হয়। কিন্তু কোনো মনোবিদ বা কোনো বিজ্ঞানী বিদ্যালয়ের অর্জিত জ্ঞানকে প্রকৃত শিক্ষা বলতে চাননি। তবে সে যা-ই হোক না কেন,শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আমাদের ছেলেবেলা থেকেই আমরা এ ণীতি বাক্যটির সাথে পরিচিত। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখতেই হয় রচনা, না হয় ভাব সম্প্রসারন হিসেবে সিলেবাসে এমন একটি অধ্যয়ন থাকতোই। এ কেবল একটি ক্লাসেই সীমাবদ্ধ নয় ক্লাস সিক্স থেকে শুরু করে পর পর অন্ত:ত চার-পাঁচটি ক্লাসে পড়তে হয়েছে শিক্ষা নিয়ে। কিন্তু আমাদের ছেলে বেলার সে শিক্ষাণীতি এখন আর নেই। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের আদলে শিক্ষা পদ্ধতিতেও বার বার আনা হয়েছে পরিবর্তন। হালে শিক্ষার পরিবেশও অনুকূল নয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংগঠনিক হানাহানি ব্যাপক। তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে অনেক দিন। এছাড়া, পরিচালনা কমিটির মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি কমিটির মধ্যে দ্বন্দ্ব ব্যাপক। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, নকল, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি ব্যাপক।

 

অর্থাৎ দেশের শিক্ষা খাতের অবস্থা চরম খারাপ! ফলে দেশের কাঙ্খিত ও সার্বিক উন্নতি হচ্ছে না। এই অবস্থায় দেশের সার্বিক ও টেকসই উন্নতির জন্য সময়োপযোগী তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষা অপরিহার্য। উপরন্তু এসবের সার্বক্ষণিক হালনাগাদ উদ্ভাবন শিক্ষার সাথে যুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে, ইংরেজি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা। এর গুরুত্ব বিশ্বব্যাপীই। তাই এই ভাষাকে দেশের শিক্ষার সাথে যুক্ত করা দরকার। মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এটিও শিক্ষার সাথে যুক্ত করতে হবে। বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য কারিগরি শিক্ষাও আবশ্যক। সুতরাং শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন অত্যন্তই জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে।

তবে আমাদের পতিত সরকার যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছিল তা নিয়ে আপত্তি উঠেছে সর্বমহলে। এমনকি জাতীয় সংসদেও একাধিক সদস্য এর অসংগতি নিয়ে কথা বলেছেন। এ নিয়ে শহীদ মিনারে মানববন্ধন এবং প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। অভিভাবকরা বলছেন, “নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাসায় বই নিয়ে বসছে না। পড়তে বললে তারা বলছে,পড়ার তেমন কিছু নেই। স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম ‘গ্রুপ স্টাডিজ’-এর কাজ দেওয়া হচ্ছে, যা সমাধান করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নানা রকম ঝামেলায় পড়ছেন। এসব ঝামেলার মধ্যে আছে: স্কুল ছুটির পর সহপাঠীদের বাসায় গিয়ে গ্রুপ স্টাডিজের কাজ সমাধান করা, এই কাজে অনেক সময় লাগা, কাজের উপকরণ ক্রয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হওয়া, গ্রুপ স্টাডিজের অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের অনিয়ন্ত্রিতভাবে ডিভাইস ব্যবহার করা ইত্যাদি।

 

তাছাড়া নৈতিকতার প্রশ্নে যে অভিভাবকরা আপত্তি তুলেছেন তাদের বক্তব্যটা এ রকম: নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার নামে যা শেখানো হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে ‘যৌন শিক্ষা’। অভিজ্ঞ অভিভাবকদের মতে এ পর্যন্ত যে কয়টি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ও বাস্তবতাবর্জিত শিক্ষাক্রম হলো নতুন শিক্ষাক্রম।

 

তাদের মতে, ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে দুর্বল হচ্ছে জাতীয় মেরুদন্ড । তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী হতে উৎসাহিত না করে বরং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করা চাই। এ দাবি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জ্ঞান মানুষকে দক্ষ করে, কিন্তু জ্ঞান তো ভাসমান তথ্য নয়, তার অভ্যন্তরে যদি তত্ত্ব না থাকে। আর ডিভাইসমুখী করে স্মার্ট করা? সে তো শিক্ষার্থীকে যান্ত্রিক ও চালিয়াত করারই নামান্তর। চালিয়াত আর দক্ষ এক জিনিস নয়। আর এটাও তো এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সত্য স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের বিষন্নতা বৃদ্ধি করে চলেছে।

 

আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের আপাত অবসানের পর সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সংস্কারের কথা যেহেতু উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। বিগত বছরগুলোয় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন উপলব্ধি থেকেই শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও মনে করছি। কারন শিক্ষা যেমন একটি চলমান প্রক্রিয়া তদ্রুপ সংস্কারও একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। তবুও আমাদের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এই শিক্ষাব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এটিকে এগিয়ে নেওয়া এই সময়ের চ্যালেঞ্জ। তাই তো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যনির্ভর  বিশ্বপরিমন্ডলে জাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকতে হলে অবশ্যই শিক্ষার প্রসার ও বিস্তার ঘটাতে হবে। বিশেষ করে যুগোপযোগী প্রযুক্তিঘনিষ্ঠ শিক্ষার প্রসার একান্ত প্রয়োজন। সমন্বিত প্রচেষ্টায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সফল হোক আজকের দিনে এ প্রত্যাশাই করি।

 

মো.ইউসুফ আলী (সাংবাদিক ও কলাম লেখক)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *