নিজস্ব প্রতিবেদক:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পদ্মাপাড়ের ইউনিয়ন চরবাগডাঙ্গা। জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরেরে ভারতীয় সীমান্তঘেষা ইউনিয়নটি মাদক কারবারিদের অন্যতম ‘সদর দফতর’। ভারত থেকে আসা হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের প্রথম স্টেশন চরবাগডাঙ্গা। পরে মাদক কারবারিদের হাত ঘুরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আলাদিনের চেরাগ এই ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে চলে অবৈধ অর্থের মহড়া। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা মাদক কারবারে জড়িত। আওয়ামী লীগ নেতাদের পৃষ্টপোষকতায় গত কয়েক বছরে মাদক কারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এই ইউনিয়ন। ৫ই আগস্টের পর মাদক উদ্ধারকারি সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রীয়তায় চরবাগডাঙ্গার মাদক সিন্ডিকেট এখন আরও বেপরোয়া। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদকের অবৈধ টাকার কাছে জিম্মি হয়েছে পড়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও মাদক কারবারিদের হাতেই।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, মাদকের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নুরুল ইসলাম চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছেন। রাজধানী ঢাকা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন নুরুল ইসলাম। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি ও চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নং ওয়ার্ড সদস্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দল ওদুদের ছত্রছায়ায় নুরুল মেম্বার মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নেন। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই তার শক্তিশালি নেটওয়ার্ক রয়েছে। মাদক কারবারে আধিপত্য ধরে রাখতে এখন বিএনপিপন্থী নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়েছেন।
এ কারণে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেলেও নুরুল এলাকাতেই আছেন। তার মাদক কারবার চলছে আগের মতোই। অভিযোগ রয়েছে, তাকে শেল্টার দিচ্ছেন কৃষক দলের এক নেতা। ফলে ক্ষমতার পালাবদলেও এই তাঁতী লীগ নেতার মাদক কারবারে প্রভাব পড়েনি। নুরুলের হাতেই এখন এ অঞ্চলের মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ। অবৈধ অর্থের প্রভাব খাটিয়ে এলাকার রাজনীতিরও নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিরা। সোর্স আব্দুল হাকিম পিন্টুর ‘রহস্যজনক’ হত্যাকা-কে পুজি করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে নেমেছেন নুরুল ইসলাম। শুরু করেছেন আসামি বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে মাদকের গডফাদার নুরুল ইসলামের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদক ঢোকে ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ দিয়ে। ভারত থেকে আসা ভয়ংকর মাদক হেরোইনের অন্যতম প্রবেশদ্বার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নটিকে মাদকের স্বর্গরাজ্য বলা হয়। দুই দশক ধরে ব্যাপক হারে হেরোইন-ফেনসিডিল ঢুকছে এ ইউনিয়ন দিয়ে। এখন ইয়াবাও আসছে বিপুল পরিমাণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে চারটি বাড়ি রয়েছে নুরুল ইসলামের। এরমধ্যে তিনটি চারতলা ভবন। আছে দুটি প্লট। বরেন্দ্র অঞ্চলে আছে ৩০ বিঘার বাগান। ঢাকার রায়ের বাজারে বাড়ি ও প্লট আছে। বেকার দুই ছেলেও চলাফেরা করেন দামি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলে। তবে নেই দৃশ্যমান কোনো আয়ের খাত। অভিযোগ উঠেছে, এসব করেছেন মাদক কারবার করে। মাদকের তিনটি মামলার আসামি তিনি। পদ্মা নদী পেরিয়ে ভারত থেকে আসছে মাদকদ্রব্য। বিভিন্ন মাধ্যমে ও কৌশলে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে নুরুল সিন্ডিকেট। তাদের হাত ঘুরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে হেরোইন-ফেনসিডিল ও ইয়াবা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনমজুর থেকে চোরাচালান শুরু করেন নুরুল ইসলাম। এক সময় লোহার কাঁটা নিয়ে আসতেন ভারত থেকে। তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। নব্বইয়ের দশকের ঘটনা এটি। ২০০০ সালের দিকে রাজধানী ঢাকার রায়ের বাজারের সুন্দরী নামে এক মাদক কারবারিকে বিয়ে করেন তার পর থেকেই তার উত্থান। মাদক কারবার করে অনেকটা সিনেমার ভিলেনের স্টাইলেই কোটিপতি বনে যান নুরুল ইসলাম। ভাই ও ভাতিজাদের নিয়ে গড়ে তোলেন মাদকের বিশাল সাম্র্যাজ্য। মাদকের গডফাদার নুরুলের নেতৃত্বে সীমান্ত জুড়ে চলছে মাদকের জমজমাট ব্যবসা।
পিসিপিআর বা পূর্বের মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩টি মাদক মামলার আসামি নুরুল ইসলাম। পিসিপিআরে পুলিশ উল্লেখ করেছেন নুরুল ইসলাম একজন অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ভারতের সীমান্তঘেষা পদ্মাপাড়ের ইউনিয়ন চরবাগডাঙ্গার বাসিন্দাদের একটি অংশ মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাদক কারবারের নেপথ্যে জড়িত। জনপ্রতিনিধিরাও মাদক সিন্ডিকেটে জড়িয়ে আছেন। কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ হাত বদল করে, কেউ সরাসরি যুক্ত থেকে কোনো না কোনোভাবে এসব চালান পার করতে সহযোগিতা করেন। সরকার পরিবর্তনের পরেও ওই এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের কব্জাতেই রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার তাঁতী লীগ নেতা নুরুল মেম্বার। যাকে এলাকার সবাই মাদক কারবারি হিসেবে চেনেন। শুধু নুরুলই নয় তার পুরো পরিবারই মাদকের সঙ্গে জড়িত। মাদকের ব্যবসা করে নুরুল ও তার ভাই ভাতিজারা আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকাসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে রয়েছে তাদের একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি। এতদিন নুরুল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ব্যবহার করে মাদক সিন্ডিকেট চালিয়েছেন। ক্ষতার পালাবদলেও বীরদর্পে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।
মাদকের গডফাদার নুরুল ইসলামের ভাই মাইনুল হাজি, মুনিরুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ও ভাতিজা আলমগীর হোসেন। চরবাগডাঙ্গার বাসিন্দা ভাই-ভাতিজা মিলে গড়ে তুলেছেন মাদক ব্যবসার পারিবারিক এক সিন্ডিকেট। ভারত থেকে হেরোইন-ইয়াবাহ এনে সারাদেশে সরবরাহ করে তারা। ঢাকার রায়ের বাজার ও আশুলিয়ায় তাদের রয়েছে আলাদা সাব-সিন্ডিকেট। মাদক ব্যবসা করে নুরুল, মাইনুল, আলমগীর এবং তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। এদের সবার নামেই মাদক মামলা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যেখানেই মাদক সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পর্যায়ক্রমে মাদকের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা হবে। চরবাগডাঙ্গার অনেকেই আমাদের নজরদারিতে আছে। মাদক ব্যবসায় যারা অবৈধভাবে সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাদের অবৈধ সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারি কোষাগারে সুযোগ রয়েছে। এসব বিষয়েও কাজ করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নুরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।