অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম থেকেই যে কটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তার একটি বাজার নিয়ন্ত্রণ। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছেনা কোন কিছুই । দাম বাড়তি থাকায় বিপাকেই পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের দাম না মেলার কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা। মোদ্দা কথা বাজার করতে গিয়ে যেন চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। ফলে পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে সরকারের সকল ধরনের চেষ্টা-প্রচেষ্ট। টানা তিন থেকে চার সপ্তাহ ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সবজির দাম। কাঁচা মরিচ ওঠে পাঁচ’শ টাকা পর্যন্ত। পিঁয়াজ এক’শ দশ-পনের ছাড়ায়। যদিও পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ডিমের শুল্ক ছাড়, আমদানির অনুমতি এবং নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তেল-চিনিতেও শুল্ক ছাড় দিয়েছে। কিছু পণ্যের দাম বেঁধেও দিয়েছে।
কিন্তু বাজারে তার বিশেষ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ডিমের দাম সামান্য কমলেও মুরগির দাম কমেনি বরং বেড়েছে। কাঁচা মরিচ সামান্য কমলেও আসেনি ক্রেতাদের স্বস্তির নাগালে। একই অবস্থা সবজিতেও। মোট কথা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কিছুই বিক্রি হচ্ছে না। ফলে বাজার করতে গিয়ে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস। দিশাহারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। সুতরাং পণ্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার লাগাম টানতে হবে এখনই।
এ প্রতিবেদনটি লেখার স্বার্থে সরাসরি বাজারে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানাযায়,সাধারণ মানুষের দুখ:কষ্টের নানা বেদনাবিধুর গল্পের কথা। কেনাকাটা করতে এসে এখন আর শান্তি পাই না। যে হারে প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না বেতন ভাতা । এমন অস্বস্তি নিয়ে আর কত দিন চলতে হবে জানি না। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এমন মন্তব্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শরীফ হোসেনের।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে । বেড়েছে মাছ,মুরগীসহ সকল প্রকার সব্জির দাম। সেই সাথে বেড়েছে আলু, পেয়াজ-আদা ও রসুনসহ সব ধরনের মসলার দামও। ফলে কেনাকাটা করতে এসে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন এবং মধ্য আয়ের মানুষদের।
দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের আগানগর কাঁচা বাজারের কেনাকাটা করতে আসা মাহবুব আলম বলেন, ‘মাছের বাজার একদিকে যেমন অনেক চড়া, অপরদিকে চাষের বাইরের দেশীয় জলাশয়ের মাছের দেখা মেলাই ভার। সুতরাং একপ্রকারের বাধ্য হয়েই পাঙ্গাস-তেলাপিয়াসহ হ্যাচারির অন্যসব মাছের দিকে ঝুকতে হচ্ছে। যেসব মাছে নাই স্বাদ বরং রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুকি।
তিনি বলেন, যে টাকা ইনকাম করি তা দিয়ে সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এভাবে বাড়তে থাকলে এক সময় না খেয়ে থাকতে হবে।
বাজার করতে আসা দিন মজুর রহমত আলী বলেন, বাজারে প্রায় সব ধরনের মাছের দাম বেশি। পছন্দসই শাক-শবজিও মিলছে না। যা-ও আছে তা আবার বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ডিমের দাম কমলেও তা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই সারাদিন কাজ করে যা পাই এই টাকা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর।’
স্কুল শিক্ষক মো.রুহুল আমীন বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ার ফলে আমাদের সাংসারিক খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আমদের খাবার দাবারে। শেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছি তা মনে পড়ে না। আগে সপ্তাহে ৩-৪ দিন মুরগির মাংস খেলেও এখন সপ্তাহে ১ দিন খাচ্ছি। এ থেকে স্পষ্টতই প্রমানিত হয় যে,নিত্যপণ্য কিনতে হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ। গত সপ্তাহজুড়ে ১০০ টাকার কমে মেলেনি কোনো সবজি। ডিমের দাম ছিল রেকর্ড পরিমাণ। তবে সরকারের হস্তক্ষেপে ডিমের দাম কিছুটা কমলেও এবার বাজারে বাড়ছে মুরগির দাম। সরকার নির্ধারিত দামের থেকে ব্রয়লার মুরগি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর সোনালি মুরগি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপণ্যের এই বাড়তি দামের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষ শুধু নয়, মধ্যবিত্তরাও এখন সংসার চালাতে কঠিন সময় পাড় করছেন।
বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ভোগ্যপণ্য আলু, পিঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পিঁয়াজ ও আলু বিক্রি হচ্ছে আরো অনেক বেশি দামে। ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও দাম বেড়েই চলছে। সোজা কথায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম মানছেন না বিক্রেতারা। শুধু ডিম-পিঁয়াজ নয়, সব ধরনের সবজি ও মাছের দামেও বিরাজ করছে অস্থিরতা । পেঁপে ছাড়া অন্য কোনো সবজির কেজি মিলছে না একশ টাকার নিচে। বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা থাকে না। বাজারে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সরকারের যা করা উচিত তা হলো পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে যে অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজি হয় তা রোধ করা। এ দুটি ক্ষেত্রে কোনো অবদান না রেখে ভোক্তা অধিকারের নামে তথাকথিত অধিদফতর গড়ে তোলা হয়েছে এবং দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার যে ভুল কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা সরকারি কর্মকর্তাদের উৎকোচ বৃদ্ধিতে মদদ জোগাচ্ছে। যে কারনে কম করে হলেও গত প্রায় এক বছর ধরেই ক্রমাগত উত্তাল বাজার। তা নিত্যপণই হোক কিংবা নির্মাণ সামগ্রী ও প্রকাশনা উপকরণই হোক। সবকিছুই লাগাম ছেড়েছে। কিন্তু না এ নিয়ে যেন মাথাবক্যাথা নেই কারোরই। তাইতো দেশের সাধারণ মানুষ এখন আর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে চায় না। যে কারনে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখনও আকাশছোঁয়া। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দাসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। প্রতিটি ডিমের দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকা। সবজির দাম বেড়েছে আরো অনেকগুণ। মাছ-মাংসে হাত দেওয়ার উপায় নেই। অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো মসলার বাজারেও চলছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। চড়া দামের কারণে নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তারা রান্নার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মসলার ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাজারে ডিম, পিঁয়াজ, আদা, রসুনের গায়ে যেন আগুন লেগেছে। মহাবিক্রমে দাম বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের।
বস্তুত অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই দিন দিন তাদের লোভ বাড়ছে। তারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। বাজার তদারকির কথা শোনা গেলেও বাস্তবে এ ধরনের তৎপরতা কোনো বাজারেই দৃশ্যমান নয়। বাজার তদারকি সংস্থার উদ্দেশে আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, নিত্যপণ্যের প্রতিটি বাজারে নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থা করুন। চিহ্নিত করুন সিন্ডিকেট। অসৎ ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করে আইনের আওতায় আনুন। এ ধরনের কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দেখবেন অতি মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়ে গেছে। আর তা না পারলে সেটা বাজার তদারকি সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা বলে পরিগণিত হবে।
মুলত:সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দুটি বিষয় প্রত্যাশা করে তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ অন্যটি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ। বিগত দুই মাসেরও অধিক সময়ে যার কোনটিই নিয়ন্ত্রনে আনতে পারেনি ড.মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধিন এ অন্তর্বর্তী কালিন সরকার। তবে এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের সবকিছু করবে, জনগণ তা দেখতে চায়। সুতরাং বাজারের এহেন পরিস্থিতিতে সরকারকে বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের বিশ্বাস নিজেদের স্বার্থেই সরকার নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে যত্নবান হবেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যা যা করা দরকার প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার সব কিছুই করা হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ প্রত্যাশা আজ গোটা দেশবাসীর। কাজেই দেশের মানুষের আস্থা ধরে রাখতে কীভাবে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া থামানো যায়, সরকারকে সে ব্যাপারে তৎপর হতে হবে সবার আগে।
লেখক-সাংবাদিক ও কলাম লেখক মোঃ ইউসুফ আলী