পুলিশ বাহিনী সু-সংগঠিত করণ সময়ের দাবি

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন অন্যতম। কারন বাংলাদেশ পুলিশই বাংলাদেশের একমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগনের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাডিশনাল চরিত্রে । শুধু আইনের শাসন আর অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনই নয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পুলিশের রয়েছে একটি দীর্ঘ এবং অনেক পুরোনো ইতিহাস আছে।

ইতিহাসের একটা গবেষণায় দেখাযায় যে পুলিশ ছিল পুরাতন সভ্যতা হিসাবে। রোম শহরে পুলিশ দেশ সম্পর্কে অগাস্টাস সময়ে ওঠে মুষ্টি শতাব্দীর খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। পুলিশি ইতিহাস বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বেশ পুরানো। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হল ১৯৭১ সাল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। পাকিস্তান বাহিনী যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস চারদিক দিয়ে ঘিরে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছিল, তখন পুলিশ লাইনসের চারশ বাঙালি সিপাহি বুকফাটা চিৎকারে রাজারবাগ কাঁপিয়ে বলছিলেন, অস্ত্র দাও। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দাও। আমরা লড়ব। লড়তে লড়তে মরব। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করব,। কিছুতেই পিছু হটব না, হটব না’। টগবগে তরুণ বাঙালি পুলিশ সদস্যরা এমনভাবেই সেদিন শত্রুর মোকাবিলায় আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। এমনই ইস্পাতকঠিন যাদের মনোবল, এমনই গৌরবময় ইতিহাস যাদের, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ পুলিশের আজকের অবস্থা দেখে সত্যিই দুঃখ হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সংগঠন গড়ে উঠেছে, তাদের পরিণতি যে এমন হবে তা কল্পনাও করা যায়নি।

৫ আগস্ট স্বৈরশাসকের পতনের পর যেভাবে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ হয়েছে, অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, পুলিশ সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ছিল সব ধারণার বাইরে। পুলিশের প্রতি জনরোষের এত তীব্র বহিঃপ্রকাশ এর আগে কখনো দেখেনি কেউ।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতর থেকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক পরিসংখ্যান থেকে জানাযায় ৫আগষ্টের ঘটনার পর থেকে এখনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন ১৮৭ পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে ছুটিতে অতিবাস ৯৬ জন, কর্মস্থলে গড়হাজির ৪৯ জন, স্বেচ্ছায় চাকরি ইস্তফা দিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ৩ জন। এছাড়া অন্য কারণে আরো ৩৯ জন পুলিশ কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের এমন পরিণতি কেন হলো? এর জন্য দায়ী কে? পুলিশের আজকের অবস্থার জন্য কি পুলিশই দায়ী? নাকি অন্য কেউ? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। যে পুলিশ সার্ভিসের মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবগাথা আছে, যাদের জঙ্গিগোষ্ঠী দমনে সাফল্যের রেকর্ড আছে, দেশের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে যে পুলিশ জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, যে পুলিশের জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা, সে পুলিশকে কেন এভাবে জনগণের মুখোমুখি করে দেওয়া হলো? আসলে স্বাধীনতার পর থেকেই ‘পুলিশকে পুলিশের মতো’ গড়ে তোলা হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার দলীয় স্বার্থে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। দলের প্রয়োজনে পুলিশকে পরিণত করেছে নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনীতে । অথচ পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা পুলিশের এক বিপরীত চরিত্র ফুটে উঠেছে। আসলে, তিনি পুলিশকে রক্ষীবাহিনীর আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেমন সেনাবাহিনীর প্যারালাল রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, শেখ হাসিনাও পুলিশকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যেভাবে গুলি করে পাখির মতো বাঙালি মেরেছে, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরাও গণঅভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে ওই একই কায়দায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানিদেরও হার মানিয়েছে। তাদের নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা এবং রক্ত হিম করা রোমহর্ষক হত্যাকান্ড বর্বরতার সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে, যা দেখে সহ্য করা যায় না। ভাবতেও অবাক লাগে, একজন পুলিশ সদস্য কতটুকু বর্বর হলে একজন নাগরিক হয়ে নিজ দেশের আরেকজন নাগরিককে এমন নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহারের এই সুবর্ণ সময়ে পুলিশের এসব কর্মকান্ড সারা বিশ^বাসী যে যারমত উপলব্দি করেছে এবং বাংলাদেশ পুলিশের এসব কর্মকান্ডকে দেশের জনগণ  ঘৃনা ভরেই দেখছে।

কিন্তু পুলিশতো জনগনের বন্ধু হয়েই থাকার কথা। তাদের সেই লোক দেখানো শ্লোগান কোথায় ? যেখানে শ্লোগান ছিল পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ। নিজেদের ণীতি-আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে রাজণীতির বটতলে দাড়িয়ে রাতরাতি অধিক টাকা কামানোর মানষে দেশের মানুষের সাথে যে বে-আইনী কর্মকান্ড করেছেন তারই প্রতিফলন আজকে পুলিশ বাহিনীকে এ পর্যায়ে নিয়ে দাড় করিয়েছে। কারন শেখ হাসিনা পুলিশকে নিজস্ব বাহিনী রূপে গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য নিয়েই তিনি এ কাজটি করেছেন। বিগত দেড় দশকে পুলিশে রিক্রুটমেন্টের সময় আওয়ামী লীগ পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় আদর্শে বিশ্বাসীদেরই পুলিশে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারের লোকদেরই বাছাই করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার প্রতিফলন আজকের এ পরিস্থিতি।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশে-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। যা সারা বিশে^র কাছে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করে। এবারের এই জুলাই আন্দোলনেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভুমিকা দেশবাসীকে আশ^স্ত করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরনের দায়িত্বশীলতার ও খ্যাতি অর্জনের জন্য দেশবাসীর পক্ষথেকে বক্ষ প্রশস্ত করে ফৌজি নিশানায় আরো একবার স্যালুট জানাই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীকে কি করা উচিত তা ঠিক এই মূহুর্তে  এখনও ভেবে উঠতে পারিনি।  তারপরও আমরা শুধু এতটুকুই বলতে চাই যে, দেশে আইনের শাসন জারি রাখতে হলে পুলিশকে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এ জন্য পুলিশকে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত হতে হবে, যাতে কেউ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে না পারে। জনগণ বাধ্য হয়েই পুলিশের কাছে যান, কিন্তু যে সাহায্যের আশায় পুলিশের কাছে যান, পুলিশ যদি সেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেয়, তখন পুলিশের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকে না।

গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তাতে দিনে দিনে পুলিশের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়েছে। যদিও দলীয় সব সরকারই রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করেছে, তবে গত তিনটি টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সদ্য সমাপ্ত এ ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ পরিনত হয়েছিল জনরোষের টার্গেটে। যার শেষ পরিনতি হিসেবে পুলিশকে দিতে হয়েছে রক্ত। জনরোষে লন্ড-ভন্ড হয়ে পরেছে পুলিশি কার্যক্রম। জনসম্মূখে নিজেদের চেহারা দেখাতে লজ্জাবোধ করছেন জনমানুষের অতিপরিচিত সেই পুলিশ সদস্যরা। যে কারনে জুলাই আন্দোলনে দেড় মাসেরও অধিক সময় অতিবাহিত হলেও এখনও শৃঙ্খলা ফেরেনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে। কাজেই বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বর্তমান এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষে প্রয়োজন মাফিক যেমন ঢেলে সাজাতে হবে, তদ্রƒপ দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ বাহিনী সু-সংগঠিত করণও এখন সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে।

মো.ইউসুফ আলী (সাংবাদিক ও কলাম লেখক)

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *