বাংলাদেশ জোয়ার ভাটার দেশ। প্রকৃতির জোয়ার ভাটার মতই এদেশের মানুষও ঘন ঘন রং বদলায়। কথায় বলেনা যে মানুষের মন আর আকাশের রং বদলে যেতে সময় লাগে না। বাঙালীর প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই যেন এমন উক্তি প্রযোজ্য। এ দেশের বেশীর ভাগ মানুষের মন-মননও তাই। তারা কখন কি করেন আন্দাজ করা কঠিন। তারা এখন চাইবে রাষ্ট্র সংস্কার আবার ক্ষনিক বাদেই বলবে নির্বাচন চাই। তাদের মত ও আদর্শের সাথে বিন্দু মাত্র মিলও খুঁজে পাওয়া ভার। রাষ্ট্র ক্ষমতায় কেউ চেপে বসলে তাকে টেনে নামানোর জন্য চাই আন্দোলন। চাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার, আবার নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় বসা মাত্রই দিতে হবে নির্বাচন। এ যেন আমাদের প্রথাগত অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে।
ক্ষমতায় যাবার জন্য যারাই সংবিধানের দোহাই দেয় আবার ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারাই সেই সংবিধানে নিজেদের ইচ্ছেমত সিজার চালায়। বর্তমান অন্তর্বর্তী কালীন সরকার নিয়েও তারা যেন একই টালবাহানা জুড়ে দিতে চাইছে। যা জাতির জন্য মোটেই সুখকর কিছু বয়ে আনতে পারবে বলে মনে হয়না। বরং এধরনের টালবাহানা না করে আমাদের প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই উচিত অন্তর্বর্তী সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা। প্রতিটি সরকার গঠনের সময়ই আমরা তাদের প্রসংশায় পঞ্চমূখ হয়ে উঠি। ঠিক পরবর্তী সময়েই যেন সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার তার সকল কাজের অপ-প্রচারে লিপ্ত হই আমরা। এর অন্যতম কারন আমাদেরকে বলা হয় একটা, আমরা শুনি আরেকটা, বুঝি আরেকটা। আরেকজনকে জানাই আরেকটা। এই দোষে দোষি করার অপচষ্টা চালানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও।
আমরা জানি বৈষম্য বিরোধি ছাত্র-জনতার দাবির মুখে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈষম্য বিরোধি ছাত্র-জনতার সমন্বয়কদের অনুরোধে তিনি এ পদে পদায়িত হন। অথচ এ সরকারের বয়স দুইমাস অতিক্রম হতে না হতেই তাকেই ব্যর্থ করার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে একাধিক মহল। এ নিয়ে বিশ্লেষকরা মনে করেন প্রশাসনে এখনো পতিত সরকারের অনুগত আমলারা জেঁকে বসে আছেন। পুলিশসহ অন্যান্য সেক্টরেও তাই। প্রশাসনে বদলি, পদায়ন, নিয়োগ, ইত্যাদির নামে যা হচ্ছে তার সবই প্রায় ওই সরকারের অনুগতদের হাতেই যাচ্ছে। কারন বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে গড়ে তোলা পতিত সরকারের অনুসারীরা প্রশাসনের পরতে পরতে সক্রিয় রয়েছেন তারা একের পর এক ষড়যন্ত্রের কার্ড ছুড়ছেন। হুমকি দিচ্ছেন, ড. ইউনূস এক মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। ড. ইউনূসকে ব্যর্থ করার এ অপচেষ্টা এখন আর ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে নয়। এটি এখন পুরোপুরি রাজনীতি। তাকে অসম্মানিত করা, ব্যর্থ করার এ রাজনীতির বিস্তার বাড়ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্টের সাফল্য মেনে নিতে না পারা মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। তারা প্রকাশ্যে নয়, অন্তরাল থেকে যা করার তার সবই করছে। ঠিক এমনই এক কঠিন বাস্তবতাকে সঙ্গীকরে চরম অসহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের মধ্যেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একাই এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
তবে মহীরূহ হয়ে ওঠা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, তাতে কোনো কাজ হবে না। কারণ তিনি ঠিক পথে রয়েছেন। তার উদ্যোগ এবং কর্মপ্রক্রিয়া জনগণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিপুলভাবে সমর্থিত ও সমাদৃত। তবে আমাদের এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত। নইলে এ জাতির জন্য খুব একটা ভালো কিছু আশা করা ঠিক হবে না। যাই হোক ঠিক কোন মূহুর্তে কিংবা কোন পরিস্থিতিতে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে সে বিষয়ে দেশবাসী সকলেই অবগত। দেশের ঠিক এমনই এক মূহুর্তে সেনাবাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতায় না গিয়ে যে দুরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে করে সারা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ভাবমূর্তী উজ্জল হয়েছে। এ নিয়ে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানও যেমন প্রসংশা কুড়িয়েছেন সর্বমহলের, তেমনি স্বল্প সময়ে গঠিত ড.মুহা:ইউনূস সরকারেরও প্রসংশা করেছেন দেশী-বিদেশী নানা মহল। বিশ^ব্যাপী অভিনন্দন আর অভিবাদনে বেশ কিছুদিন যাবত স্ব-রব ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কেবল নোবেল বিজয় নয় আরো বহু গুণে গুণান্বিত এই বাংলাদেশী কৃতিমানকে গোটা বিশ্ব যেন এক নামেই জানে। যে কারনে রাজনৈতিক উত্থান-পতনে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আনতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ভরসা রাখছেন আপামর ছাত্র-জনতা। আর তিনিও আজ বনে গেছেন গরিবের ব্যাংকার থেকে বাংলাদেশের সরকার প্রধান। ড. ইউনূস, যিনি মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে অভূতপূর্ব সফলতার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
গত ৫ আগষ্ট সোমবার শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আকস্মিক ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পর, পরের দিন মঙ্গলবার দেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে এ অর্থনীতিবিদকেই মনোনীত করা হয়। ড. ইউনূস যদিও এতদিন যাবতীয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। তবে এখন তিনিই বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত মুখ, যার পশ্চিমা অভিজাতদের সঙ্গে ওঠাবসার ক্ষেত্রে রয়েছে যথেষ্ট প্রভাব ।
সুতরাং দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এসে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ৮৪ বছর বয়সে এসে ড. ইউনূস তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর তরুণদের সম্মিলনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার নবযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন ঠিক এমনটাই মনে করছেন দেশের আপামর জনগণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দুই মাস অতিবাহিত হল মাত্র। এরই মধ্যে নানা মহলের নানা চাপ সামলাতে হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরের এ সরকারকে। উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ ইদানিংকার উদ্ভুত এ ধরনের পরিস্থি উপলব্দিকরে বক্তব্য দিচ্ছেন যে,সবেতো দুই মাস পেরুলো। কোন রাষ্ট্র সংস্কারে দুই মাস কোন সময়ই নয়। সুতরাং তাদের পক্ষ থেকেও কোন ধরনের উস্কানি মূলক বক্তব্য কিংবা পোষ্ট না দেয়ার জন্য দেশবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কথায় আছেনা যে,চোর শোনেনা ধর্মের কাহিনী। আমাদের বাঙালীর স্বভাবটা ঠিক একই রকম।
সুতরাং আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’। সবাইকে আনতে হবে জবাবদিহিতার আওতায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের পর জার্মানিকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রধান বাধা ছিল, ঘাপটি মেরে থাকা নিকট প্রতিপক্ষ, ভোল পাল্টানো সুযোগসন্ধানীরা, পরাশক্তি প্রথিত গুপ্তচর বা এজেন্ট। সুতরাং প্রতিপক্ষ যেন জিতে না যায়। প্রতিবিপ্লব যেন মাথা চাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। সেজন্য প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের গতিবিধির দিকে, ষড়যন্ত্র পাকানোর দিকে সবাইকে সম্মিলিতভাবে রাখতে হবে কড়া নজর। রাষ্ট্র মেরামতের অতি প্রয়োজনীয়তার তাগিদের মুখে যদি দেখা যায়, আগের অপশক্তি ভিন্ন নামে ভিন্ন কায়দায় একই অপকর্ম, অপচেষ্টা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটেড তৎপরতা, দখলদারত্বের মনোভাব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও তৎপর, এমনকি ক্ষমতাধর হওয়ার আগেই নিজেদের মতো করে সবকিছু খবরদারি বা প্রত্যাবর্তনের ভূমিকায় নামে তাহলে দিনের শেষে দেখা যাবে, অবস্থার একই পরিণতি অর্থাৎ যে লাউ সেই কদু পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে।
একটি জাপানি প্রবাদ আছে যে, পাঁচ ইঁদুর একসঙ্গে ধরতে চাইলে চালাক ইঁদুর ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। গণ অভ্যুত্থানের পর অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা বৈষম্য দূর কিংবা সর্বত্র সমতা বিধান তথা সংস্কার প্রণয়ন প্রচেষ্টার অনেক দাবি পূরণের কর্মসূচি একসঙ্গে না নিয়ে যে কাজ এ মুহুর্তে সুচারুরূপে সম্পাদনের সামর্থ্য আছে সেটির প্রায়োরিটি ঠিক করা উচিত। অনেক কাজ একত্রে করার সক্ষমতা ও দক্ষতা না থাকলে কোনো কাজই সুচারুরূপে শেষ করা যায় না। ফলে একপর্যায়ে হতাশা চলে আসে, হতোদ্যম হয়ে পড়তে হয়। সুতরাং গত কয়েকদিনের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে সেটা ড. ইউনূসের জন্য কোনো ছোট কীর্তি হবে না। চিন্তা থেকে যেহেতু কাজের উৎপত্তি সেহেতু কতিপয়ের নয়, সবার দেশগত ভালোবাসার ইতিবাচক মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনায় স্বচ্ছতার শক্তি ও প্রেরণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা নতুন বাংলাদেশে এখন সময়ের দাবি। তবে বিরাজমান এই অস্থিরতার মধ্যে নানা প্রতিকুলতা ঠেকাতে কিংবা ড.ইউনূস সরকারকে সহযোগিতা করতে বৈষম্যবিরোধি ছাত্ররাই যে,বার বার এগিয়ে আসবে সেটা মনে করা কিন্তু মোটেই সঠিক কাজ নয়।যেমনটি আমরা আজও দেখছি আদালত চত্বরে। এটা কি কেবলই ছাত্রদের কাজ ? এখানে কি অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন দায় নাই ? বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বোদ্ধারা কি ভাবছেন সেটাও আমাদের বোধগম্য নয়। কাজেই আমরা আশা করব, রাষ্ট্রসংস্কারে বিএনপি,জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে সফল হতে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা।
মো.ইউসুফ আলী
সাংবাদিক ও কলাম লেখক