মো: জহিরুল ইসলাম,গাজীপুর:
বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুর মহানগরীর কলম্বিয়া মালেকের বাড়ি এলাকায় ৫৩ ঘন্টা পর টিএনজেড অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নিলেও ফের এক ঘন্টা পর মহাসড়ক অবরোধ করে। এর আগে সোমবার ১টার পর শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে মোবাইল ফোনে বক্তব্য রাখেন। শ্রম সচিব বলেছেন, সরকার দায়িত্ব নিয়ে আগামী রোববারের মধ্যে ৬ কোটি টাকা অনুদান হিসাবে দিবে। শ্রমিকদের অন্যান্য দাবি ও পাওনা কিভাবে, কবে পরিশোধ করা হবে তা আলোচনার জন্য শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে তাদের পাওনা পরিশোধ করে দিবে। এসময় শ্রমিকদের মহাসড়ক ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেছেন। আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন, আমরা অপেক্ষায় আছি। একপর্যায়ে দুপুর ২টার দিকে শ্রমসচিবের আশ্বাসে শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এরপর দুদিনের বেশি সময় অচল থাকা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
শ্রমিকদের দাবি, আশ্বাস নয়, নগদ বেতন পরিশোধ চায় তারা। শ্রমিকরা এমন অনঢ় অবস্থান নিলে এক মাসের বেতন আগামী রোববার প্রদান করা হবে, শ্রম সচিব এমন প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
পরে সোমবার ২টার দিকে টিএনজেড গ্রুপের আন্দোলনকারী শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করেছে।এসময় গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদ মিয়া, সেনাবাহিনী, শিল্পপুলিশ, ও গাজীপুর মেট্রো পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিনে আন্দোলনরত পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। বেলা ৩টা ১৫মিনিটের দিকে ফের মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা।
অবরোধের কারণে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারীরা যাত্রীরা। পাশাপাশি ক্ষুব্ধ চালক, এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষ। বাধ্য পায়ে হেঁটে গন্তব্যে গেছেন যাত্রীরা। টানা ৩ দিন মহাসড়কে অবরোধের ফলে সাধারণ মানুষের অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাতে হয়। তাদের মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে, বা বেশী ভাড়ায় বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। অপরদিকে, গুরুত্বপূর্ণ মাহসড়কটি বন্ধ থাকায় জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক কাজও ব্যাহত হয়েছে।
ময়নসিংহ থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহি পরিবহনের এক চালক জানালেন, শনিবার সকাল ৯ টা থেকে তিনি কলম্বিয়া গার্মেন্টসের উত্তর পাশে এসে আটকা পড়েছেন। ঐদিন যাত্রীরা বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে চলে গেলও তিনি এবং তার দুই সহকারী আটকা পড়ে আছেন তিনদিন যাবত।
রাস্তা শুরু থাকায় ঘুরিয়ে পিছন দিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। তিন দিন গোসল খাওয়াসহ নানা সমস্যায় পড়লেও কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে গাড়িতেই অবস্থান করছেন।
একইভাবে ঢাকা থেকে ছেড়ে কাভার্ড ভ্যানের চালক রানা জানান, তিন দিন যাবত আটকা পড়ে আছি সড়কে। কোম্পানির মাল ভালুকায় পৌঁছাতে হবে। কিন্তু সড়ক অবরোধের কারণে যেতে পারছিনা। খাওয়া ও গোসলে বাথরুমে সমস্যা হচ্ছে।
গার্মেন্টস কারখানার একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তার মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রায় ৩০ ভাগ রপ্তানি পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য এই মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করা হয়। শনিবার থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ফলে মহাসড়কটি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য বিকল্প উপায়ে রপ্তানিকারকদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। এতে রপ্তানি কারকদের সময় বেশি ব্যয় হয়েছে এবং খরচ বেড়েছে। তারপরও ধারণা করা যায় যে, দৈনিক মোট রপ্তানির চারভাগের এক ভাগ রপ্তানি বিগ্নিত হয়েছে। তাহলেও প্রায় দশ মিলিয়ন ডলারের রফতানির ক্ষতি হয়েছে। সেই হিসেবে গত ৩ দিনে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি বিগ্নিত হয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণার পর বেলা ২টা ৫০ মিনিটের দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিকেলের দিকে ফের মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা। তাদের বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এখন তারা আশ্বাস মানছে না। শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের টাকা যতক্ষণ হাতে না পায় ততক্ষণ পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ থাকবে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২-এর পুলিশ সুপার (এসপি) সারোয়ার আলম বলেন, বকেয়া বেতনের বিষয়টি সরকারিভাবে পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হলে শ্রমিকরা তাদের অবরোধ তুলে নেন। এ সময় আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন শ্রম ও কর্মস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। এতেও শ্রমিকরা মহাসড়ক ছাড়তে চাননি। তাদের দাবি ছিল, কারখানায় মালিকপক্ষ অথবা মালিক নিজে এসে বকেয়া বেতন পরিশোধ করার পর তারা মহাসড়ক ছাড়বেন। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের চেষ্টায় দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সাড়ে তিনটার দিকে ফের তারা মহাসড়কে অবস্থান নেয়।
উল্লেখ্য, টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের গত দুই মাসের বেতন বকেয়া আছে। শ্রমিকেরা দুই মাস ধরেই বেতন দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ দিব দিচ্ছি বলে কালক্ষেপণ করছে। ২৮ অক্টোবর শ্রমিকেরা আন্দোলন করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করে। সে সময় পুলিশ নভেম্বরের ৩ তারিখ বেতন পরিশোধ করা হবে জানিয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ৫ নভেম্বর আবার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ৭ তারিখ বেতন দিবে আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা ফিরে যান। ৭ তারিখ চলে গেলেও শ্রমিকেরা বেতন পাচ্ছেন না। তাছাড়া কারখানা বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ আছে। এসব কারণে গত শনিবার সকাল থেকে আবারও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা।