মো. জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর:
গাজীপুর কাশিমপুরের নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা লিপি বেগম আগে পরের বাসায় কাজ করতেন। এক শতাংশ জমিও ছিল না। মা আনোয়ারা বেগম লেবু বিক্রি করতেন। মায়ের ৪ শতাংশ জমি ছিল। এখন ৬ তলা বাড়িসহ কয়েকটা টিনশেড বাড়ির মালিক। ১০ বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক। লিপি বেগমের স্বামী ফরিদ (৫০) ৮টি বিয়ে করেছে। পুলিশের সোর্স পরিচয় দেয়। দামী মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরেন। অন্যরা হলেন বাদশা (৩৫) তিনি তিনতলা বাড়ির মালিক। সমলা (৪০), ও তার ভাই বাতেন। সমলা তিনতলা ও বাতেন ২ তলা বাড়ির মালিক।
স্থানীয় যুব মহিলা লীগ সাধারণ সম্পাদক নেত্রী ডালিয়া বেগম। তিনি সবচেয়ে বড় ডিলার। ৩/৪ বছর আগে মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। স্বামী ওয়াসীম রিকশা ভ্যান চালাতেন। এখন তারা ৫টা বাড়ির মালিক। ১০-১২ জন দিয়ে মাদক বিক্রি করেন। এভাবেই মাদকের কারবার করে রাতারাতি হয়ে যাচ্ছেন কোটিপতি। প্রভাব বিস্তার করে চলাচল করেন। স্থানীয়রা মাদকের কারবারে প্রতিবাদ জানালে নানাভাবে হয়রাণী করা হয়। এদের বিরুদ্ধে গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় মাদকের মামলা থাকলেও কিছু দিন জেল খেটে ফের মাদকের কারবারে নেমে পড়েন। পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর বারবার যৌথ অভিযানেও থামছে না মাদক কারবারিরা। মাদক কারবারি করে কেউ হচ্ছেন কোটিপতি আর সেবন করে কেউ হচ্ছেন ঘর ছাড়-সংসার ছাড়া। ভিটেমাটি বিক্রি করে পথে বসেছেন। অকালে হারিয়েছে জীবন।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর নয়াপাড়ায় ২০ মাদক ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে জিম্মি লাখ লাখ মানুষ। মাদকের ব্যবসা অনেকেই হয়েছেন বাড়ির মালিক। জমিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মাদক সেবন করে গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। তারপরও বন্ধ হয়নি মাদক, বরং বেড়েছে। মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে হামলা-মিথ্যা মামলা।
স্থানীয়রা বলেন, কাশিমপুর নয়াপাড়া গ্রামের রওশন মার্কেট সংলগ্ন কাঠলতলা মহল্লায় মাদক ব্যবসা করেন ২০ জন। তারা হলেন- সিটি করপোরেশনের ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর কাশিমপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান তুলা ও একই ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমির হোসেন কাছের লোক হওয়ায় নির্বিঘ্নে ব্যবসা করে চলেছেন। ৫ আগস্টের পর আসাদুজ্জামান তুলা পালিয়ে বেড়ালেও তার সহযোগীরা বীরদর্পে চলাফেরা করছেন। মাদকের অপর কারবারিরা হলেন ডালিয়ার ভাই রহুজুদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর (৩৫), হাছেন আলীর ছেলে আশু (৩৬), মৃত মনির উদ্দিনের ছেলে জীবন (২৮), তার মা মরিয়ম বেগম, আবদুল কসাই কসাইয়ের ছেলে রিপন (৩৮), সবুজ (৩৬), শিল্পি (৪২) ও লিপি (৪০)। তারা ৪ জনই বড় ডিলার।
রহম আলীর ছেলে জাকির (৫০), জাকির স্ত্রী সমর্ত বানু, নুরু ছেলে আলমগীর হোসেন (৪২), ডালিয়ার বোন শিপন (৩২), বাবুল মিয়ার ছেলে বাবলি (৪০), হোসেন আলীর ছেলে খোরশেদ (৪৮) প্রমুখ।
এসব মাদক কারবারিদের মধ্যে লিপি বেগম, ডালিয়া বেগম ও ওয়াসিমের সঙ্গে কথা বললে তারা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ফোন কেটে দেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে অস্বীকার করেন।
এদিকে লিপির চাচাত বোন কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী শেফালী আক্তার গুলু বলেন, মাদক কারবারিদের কাছে এলাকা জিম্মি। তার তিন ভাই আইনাল হক, মনির হোসেন ও গোলজার হোসেন মাদক খেয়ে অকালে মারা গেছেন। হিরোইন, ইয়াবা ফেন্সিডিল সবই খেতেন। ভাইদের মৃত্যুর পর তিনি মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এ কারণে মাদক ব্যবসায়ীদর টার্গেটে পরিনণত হন তিনি। গত কয়েক মাস আগে তিনি, ছেলে ও ছোট বোন মাদক কারবারিদের আক্রোশের স্বীকার হয়েছেন। দোকানে হিরোইন রেখে ফাঁসাতে চেয়েছেন। জুলাইয়ের শেষে ছেলে সোহানকে (১৮) কুপিয়েছে। ছোট বোন লিপি আক্তার (২০) ও তার উপরও হামলা হয়েছে। শতাধিক লোক নিয়ে ছেলের উপর হামলা করে। এখনো মামলা নেয়নি পুলিশ। কাউন্সিলর ন্যায় বিচারের অশ্বাস দেয়। চিকিৎসা করেন। ওদের কাছ থেকে আড়াই লাখ নিয়ে ধামাচাপা দিয়েছে শুনেছি।
জানা গেছে, গত ৯-১০ বছরের ব্যবধানে গুলুর তিন ভাই ছাড়াও মরিয়মের সাবেক জামাই মনির হোসেন (৩৫), জসিম ওরফে জসি (৪০), সবুজ (১৮), নুরুল ইসলাম, খোরশেদ, শাহজাহান, আসকর আলীও ইছু মিয়া মাদক সেবনে মারা গেছেন।
স্থানীয় অরচার্ড পয়েন্ট স্কুল এন্ড কমার্স কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. দুলাল হোসেন বলেন, মাঝেমধ্যে মাদক পল্লীতে অভিযান হয়। কয়েকদিন বন্ধ থাকে। আবার শুরু হয়। এভাবেই গত ১৫-১৬ বছর ধরে চলে আসছে। মাদক ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দেয়। দলবেঁধে হামলা করে। ওদের টাকার পাহাড়। নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জনপ্রতিনিধিরা ভোটের আগে নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে ভোটের রাজনীতির জন্য চুপ থাকে।
এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী (৬০) বলেন, তার ছেলে আওলাদ সিএনজি চালাতেন। সিগারেটও খেতেন না। দেড় বছর আগে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেড় মাস ধরে জেলে। জামিনের চেষ্টা করেন না।
স্থানীয়রা বলেন, কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় এখন কোন মানুষ বিয়ে সাধির জন্য আসে না। সবাই জানে এ এলাকার সব লোক মাদকের সাথে জড়িত। এখানে হাত বাড়ালেই মাদক মিলে সব সময়।
এ ব্যাপারে কাশিমপুর থানার ওসি মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সব সময় চলমান। ওই এলাকায় বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার ও মাদক কারবারি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদক নির্মূলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে।