সোহেল আহাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
নৌকার জন্য কখনো কখনো দুই তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি, কখনো বা ব্যাগ এপারে রেখে সাঁতরিয়ে ওপার গিয়ে নৌকা এনে তারপর ব্যাগ নিয়ে এসেছি। এক দূর্বিষহ দিন পার করেছি। যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতাম নদীর পাড়ে গিয়ে নৌকা পাবো কি না! আমার সাথে আরো দুজন পড়াশুনা করতো, তারা ঝরে গেছে। কথাগুলো বলছিলেন আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা বাশার উদ্দিন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তিতাস নদীর পূর্ব পাড় পূর্ব শিমরাইলকান্দি গ্রামের খিলন মিয়ার ছেলে।
কেউ বলে পূর্ব শিমরাইলকান্দি আবার কেউ বলে পূর্ব কান্দিপাড়া। গ্রামের বাসিন্দারা বলেন দু’নামেই পরিচিত গ্রামটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পৌরসভার মূল ভবন থেকে হেঁটে মাত্র ৫/৭ মিনিটের রাস্তা। বাণিজ্যিক এলাকা ও শহরের ঐতিহ্যবাহী আনন্দ বাজার নৌকা (তিতাস নদী) ঘাট থেকে পূর্ব পাড় অবস্থিত। গুদারা দিয়ে পার হতে সময় লাগে মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট। সব মিলিয়ে দশ থেকে বারো মিনিটের রাস্তা। গ্রামটি শহরের নিকটতম হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকার কারণে শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরত্ব সুহিলপুর ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করা হয় গ্রামটি। সুহিলপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড পূর্ব শিমরাইলকান্দি গ্রাম। শহরের সবচেয়ে বড় বাজার আনন্দ বাজার, সড়ক বাজার, জগৎ বাজারসহ বড় বড় শপিং মল ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো নদীর পাড়ে অবস্থিত।
গ্রামের বাসিন্দারা সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিকতা, রাজনৈতিকতা ও নিত্যনৈমিত্তিক কেনা বেচা সবকিছু শহর কেন্দ্রিক। পূর্ব শিমরাইলকান্দি গ্রামটি তিনটি অংশে বিভক্ত রয়েছে। এই গ্রামে হিন্দু মুসলিমসহ প্রায় তিন হাজার জনসংখ্যার বসতি রয়েছে। গ্রামটি জনবসতি ঘন হওয়ায় গ্রামের ভিতরে বয়ে চলা একমাত্র রাস্তাটির প্রস্ত দেড় থেকে দুই ফুটেরও কম। গ্রামের পূর্ব দিকে রয়েছে বিশাল জলরাশি হাওর। শুকনো মৌসুমে হাওরে ধান চাষ শুরু হওয়ার পূর্বে মাছ ধরার উৎসবে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা মেতে উঠে। গ্রামের মানুষদের মাছ ধরা এবং বেচাকেনা তাদের প্রধান পেশা। ফজরের নামাজ শেষ হলেই বাবা, চাচা কিংবা বড় ভাইদের সাথে নদীর পাড়ে থাকা আনন্দ বাজারে চলে যায় ছোট ছোট শিশুদের একটি দল। গুচ্ছ আকারে ছোট ছোট দল চলে যায় হাওরে মাছ ধরার কাজে। দুপুর দুইটা তিনটা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে তাদের। বিকেল হলেই খেলায় মেতে উঠে দূরন্ত কিশোরদের।
অপর দিকে ছোট কিশোরী বালিকারা পড়াশুনার ব্যস্ততা না থাকায় মায়ের সাথে গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাঁস-মুরগী পালন, গরু-ছাগল পালনসহ নানা কাজে কিশোরীরা নিজেদের নিয়োজিত রাখে।
হাজার তিনেক বসতি গ্রামে নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন স্কুল কিংবা মাদরাসা। ফলে শিশুরা ছোট বেলা থেকেই বাবা কিংবা চাচাদের সাথে আনন্দ বাজারে মাছ বেচাকেনা পেশায় জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া কন্যা কিশোরীরা শিকার হচ্ছে বাল্য বিবাহের। যে কয়জন শিশু পড়ার জন্য আগ্রহ রয়েছে তারা এক মহাযুদ্ধ অতিক্রম করতে হয়। বাবা মায়েরাও চায় শিশুরা তাদের পূর্বসূরীদের পেশায় নিয়োজিত থাকুক। পড়াশুনার জন্য বাবা মা”কে রাজি করাতে পারলেও সমাজকে রাজি করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এসব বিষয় তুয়াক্কা না করে যারা এগিয়ে যেতে চায় তাদের সাথে পরিশ্রম যুক্ত হয় যাতায়াত এবং অর্থ কষ্টে। সেখানে নৌকা দিয়ে পারাপারের বিকল্প নেই। কখনো নৌকা না থাকলে তাকে গ্রামে ফেরা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও গত দুই বছর পূর্বে গ্রামের দক্ষিণ দিকে সদর উপজেলা ও বিজয়নগর উপজেলার যোগাযোগের জন্য তিতাস নদীর উপরে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। একটা সময় ছিল নৌকা না পেলে হয় তাকে এপারেই রাত যাপন করতে হবে, আর না হয় তিতাস নদী সাঁতরিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। এসব দূর্বিষহ চিন্তা ভাবনা থেকেই পড়াশোনায় অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে গ্রামবাসীর।
গ্রামে প্রবেশ করেই দেখা যায় ছোট ছোট শিশুরা যার যার মত করে দল বেঁধে খেলা করছে। কেউ খেলছে দাড়িয়াবান্ধা, কেউ খেলছে বেডমিন্টন, কেউ খেলছে গোল্লাছুট কিংবা কুত কুত। তাদের খেলার মাঝে কথা বলি নুসরাত, ইসরাত, সাইমা, তাসলিমা, সাইফুল, লিটন, তানিয়া প্রীতি’র সাথে। তারা কেউ শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কেউ বা পড়ে শহরের কোন মাদরাসায়।
ব্যাংক কর্মকর্তা বাশার উদ্দিন শিমরাইলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় এসএসসি পাশ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় এইচএসসি পাশ করে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অধ্যায়ন করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সদর ও বিজয়নগর উপজেলায় যাতায়াতের জন্য নতুন রাস্তাটি আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে হওয়ায় আমরাও রাস্তাটির সুবিধা উপভোগ করছি। নতুন রাস্তাটি হওয়ায় আমাদের কষ্টের লাঘব হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়/ কিন্ডারগার্টেন স্কুল কিংবা মাদরাসা না থাকার হতাশা ব্যক্ত করেন। যার কারণে গ্রামের শিশু কিশোরেরা পড়াশুনায় পিছিয়ে রয়েছে।
কথা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর ডিগ্রি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও শিমরাইলকান্দি গ্রামের প্রীতি’ র সাথে। তিনি জানান, আমাদের গ্রামে ছয় থেকে দশ বছর বয়সের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিশু রয়েছে। অধিকাংশ শিশুরাই পড়াশুনার সুযোগ পায় না। আমাদের গ্রামটি যদিও শহরের সাথে তবুও আমরা শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের গ্রামটি মুসলিম অধ্যুষিত, এখানে ধর্মীয় অনেক বাঁধা নিষেধ রয়েছে। গ্রামের একটি মেয়ে একা যুদ্ধ করে কলেজে পড়াশুনা করা খুবই দুর্বিসহ। প্রীতি বলেন, আমাদের গ্রামের পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। কিন্তু নানান রকমের বাঁধা বিপত্তি থাকায় সাহস করতে পারছিনা।
কান্দিপাড়া মহল্লার আনাস জানান, আমি পড়াশুনার পাশাপাশি সে গ্রামের শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি শিশুদের পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়ানোর।
তিতাস নদীতে নবনির্মিত সেতুর পাশের দোকানদার ইস্তে আজম বলেন, আমরা পড়াশুনায় পিছিয়ে আছি। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে পিটিয়েও স্কুলে পাঠাতে পারিনা। না পাঠানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন সঙ্গদোষ।
তিনি বলেন, আমার ছেলেরা তার সহপাঠীদের সাথে বিলে (হাওর) চলে যায় মাছ ধরতে। তাকে হাজার বার নিষেধ করেও ফিরাতে পারিনা। এক পর্যায়ে ত্যক্ত হয়ে নিজেই পিছিয়ে আসি। কথা হয় গ্রামের আশিউর্ধ্বো সহজ সরল ইউনুছ মিয়ার (৮৫) সাথে। তাঁর ছয় মেয়ে ও পাঁচ ছেলে রয়েছে। সবাই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়েছে বলে জানান।
তিনি বলেন, আমরা গেরামের মানুষেরা সহজ সরল। আমরা গেরামে স্কুল করার জন্য কোন রাজনৈতিক নেতা কোনদিন বলেনাই। সবাই খালি আমরারে ব্যবহার করছে। গ্রামের দক্ষিণে তিতাস নদীর উপরে নির্মিত হওয়া সেতুটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, এ রাস্তাটি আমরার দরহার আছিন। আমরা লাইজ্জের কষ্ট করছি। রাস্তাডা হইবার আগে এ গেরামে জমির দাম আছিন পানির মত সস্তা। বর্তমানে রাস্তা হওয়ার কারণে গেরামের আশেপাশে আগুনের মত দাম বাড়ছে। অহন কেউ ইচ্ছা করলেও স্কুলের লাইগ্গা অত দামি জায়গা কেউ দান করতো না। পূর্ব শিমরাইলকান্দি গ্রাম থেকে শহরের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় এখন স্বল্প সময়ে যাওয়া যায়। তবুও শিশুরা স্কুলে না যাওয়ার কারণ হিসেবে নানা দিক তুলে ধরেন। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন মা বাবার অসচেতনতা। শিশুরা বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করলে দিনে চার পাঁচশতো টাকা পায় তাই মা বাবারাও চায় তার সন্তান রুজি করুক। এছাড়াও কথা হয় গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মলাই মিয়া ৬৪, মানিক মিয়া ৭০, দীন ইসলাম ৫৫ ও গ্রামের দোকানদার শরীফ মিয়ার সাথে।
শিমরাইলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিলুফা নাহার রুবী বলেন, গ্রামটি শহর কেন্দ্রিক হলেও শিক্ষা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত রয়েছে। এ গ্রামের শিশুরা আমাদের বিদ্যালয়ে পড়ে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সমাপনী শেষ হওয়ার পূর্বেই ঝরে পড়ে।
শহরের কান্দিপাড়া মহল্লার মাদ্রাসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সায়েম খান বলেন, স্কুল দূরে থাকার কারণে সেখানকার মেয়েরা স্কুলে আসতে চায় না। ইভটিজিংয়ের ভয়ে মা বাবারাও এতদূরে পাঠাতে চায় না। তাছাড়া বাবা মায়েদের অসচেতনতা যেমন দায়ী তেমনি দায়ী সামাজিকতা, রাজনৈতিকতা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। তিনি বলেন, গত বছর আমাদের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির “নদী” নামক ছোট কন্যা শিশুটির বিয়ে দেয়া হয়। সরকারের উচিত নদী সংযুক্ত গ্রামগুলোতে শিক্ষার দিকে নজর দেয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং কমিটির সভাপতি এবিএম মোমিনুল হক বলেন, আমার বাড়ি শিমরাইলকান্দি। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি এই গ্রামের শিশুরা প্রাথমিক পার করতেই ঝরে পড়ে। ফলে তারা আর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনা। একটা সময় গ্রামটি খুবই নিপীড়িত ছিল। এখন ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। বেশ ক’বছর আগে ভ্রাম্যমাণ ব্র্যাক স্কুল আসতো। কিন্তু এটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, গ্রামটি শহরের নিকটবর্তী হয়েও এ গ্রামে একটি সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি এ গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসার আহবান করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, আমরা এক হাজার স্কুল নির্মাণের চাহিদা দিয়েছি। এরমাঝে এই গ্রামের নামটি তালিকায় আছে কি না আমার জানা নেই। তালিকাটা দেখে জানাতে হবে। তালিকায় না থাকলে তাঁর কিছু করার নেই বলে জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক দিদারুল আলম মুঠোফোনে জানান, বিষয়টি আমি জানিনা, গ্রামটি কোথায় সেটাও জানিনা। আমি বিষয়টি নোট করে রাখছি। তিনি বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে যথাযথ কার্যক্রমের আশ্বাস দেন।