তোফাজ্জল : নির্মমতায় ঘেরা জীবন,বর্বরতায় শেষ!

“মিয়াজী সেলিম আহমেদ”

তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের  চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তোফাজ্জল ছিলেন ছোট। তোফাজ্জলের পরিচিতজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন মেধাবী। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর প্রেম ঘটিত কারনে মানসিক ভারসাম্য হারান তোফাজ্জল। যে কারণে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেনি। তাছাড়া  ২০১৫ সালে ওর মা বিউটি বেগমের মৃত্যু হয়। এর আগে ওর বাবা আবদুর রহমান মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। সর্বশেষ গত বছর তোফাজ্জলের বড় ভাই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নাসির হোসেন মারা যান ক্যান্সারে।ফলে এ ভব সংসারে তার আার  আপনজন বলতে কেউ রইলোনা। সব হারিয়ে এ পৃথিবীতে বড় একা হয়ে পরেন তিনি। একের পর এক আপনজন হারানোর যন্ত্রনা চেপে বসে তার বুকে। সব মিলিয়ে বিষাদ আর নির্মমতায় ঘেরা ছিল তার এতটুকু এই জীবন। যে কারণে সেদিনও ছিল তার উশকোখুশকো চুল, গলায় ঝুলছে তাবিজ। উদোম শরীরে সামনে ভাতের থালা। হাত ধুয়ে কয়েক মুঠো মুখেও নিলেন পঁয়ত্রিশ পেরোনো তোফাজ্জল।

 

হত্যার আগে তোফাজ্জলের ভাত খাওয়ার ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিনে ১৮সেপ্টেম্বর বুধবার রাত ৯টার দিকে মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে এক যুবককে ঘিরে চলছিল শিক্ষার্থীদের হাসিঠাট্টা, মশকরা। ছাত্রদের কেউ তাঁর কাছে জানতে চায়, ‘খাবার কেমন?’ ভয়ার্ত তোফাজ্জলের উত্তর, ‘খুব ভালো।’ কেউ বলছিল, ‘সেলফি ল, সেলফি ল।’ একজন জানতে চান, ‘আর কিছু লাগব?’ মাথা নেড়ে ‘না’ বলছিলেন তোফাজ্জল। কে জানত ওটা তাঁর শেষ খাবার!  সামান্য মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে সেদিন তাকে ঢাবির ওই হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে প্রথম দফায় মারধর করা হয়। এরপর ক্যান্টিনে নেওয়া হয় খাওয়াতে। এরপর তাঁর ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। ২৫ থেকে ৩০ শিক্ষার্থী দল বেঁধে তোফাজ্জলকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। স্টাম্প দিয়ে পিষে দেওয়া হয় হাতের আঙুল। বেশুমার মারে তাঁর শরীর থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। রক্তভেজা শরীরে তাঁকে নাচতে নির্দেশ দেয় শিক্ষার্থীরা। এমন সব বর্বরতার শিকার হয়ে শেষ হয় তোফাজ্জলের কষ্টমাখা জীবন। যা দেখে মনে পরে গেল শরৎচন্দ্রের একটি উক্তি। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র তার সেই কালজয়ী উপন্যাস শ্রীকান্তে এমন একটি উক্তি করেছিলেন যে, মানুষের মরন আমাকে বড় আঘাত করেনা,করে মনুষ্যত্বের মরন দেখিলে। সাম্প্রতিক সময়ে তার সেই অমর উক্তিটিই যেন আঘাত হেনেছে বাংলার  শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনে। তা হলো তোফাজ্জল হোসেনের অনাকাঙ্খিত ও চরম বেদনাদায়ক মৃত্যু।

 

যে কারণে তাঁর ওপর নির্মমতার খন্ড খন্ড ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই দাবি তুলেছেন এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির । বড়লোক বাপের সুন্দরী কণ্যা কর্তৃক প্রেম প্রত্যাখ্যান ও একের পর এক স্বজন হারানোর পর একমাত্র স্বজন ছিল ভাবী। কিন্তু তোফাজ্জেল এতোটাই হতোভাগা ছিলো কোন দিন ভাবির আদর মাখা হাতের একপেট  ভাতও খেতে পারে নাই সে । আজ সেই পাগলাটা ভাতের খোঁজেই মারা গেলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠিক এমনই মন্তব্য করেছেন তার এক নিকট আত্মীয়।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আত্মীয় আরো জানায়, তোফাজ্জেলের পরিবারের শেষ আশ্রয়স্থল ছিলো ওর একমাত্র ভাবী, যে কিনা ওর সাথে কুকুর বিড়ালে মতোই আচরন করতো। তোফাজ্জেল  সুস্থ্য হোক সে সেটা কখনোই চায় নাই। কেন চায় নাই এমন প্রশ্ন করতে সে জানায় এর অন্যতম কারন হল তোফাজ্জেল সুস্থ্য হলে পিতার সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে সে। যে কারণে সে তার ঘরে ফেরা কখনই কামনা করেনি। তবুও ঢাবির ফজলুল হক হলের ছাত্ররা  যখন তার ওপর নির্মম অত্যাচার করতে ছিলো,তখন অভাগাটা, নিরুপায় হয়ে ভাবীকেই কল দিতে বলেছিলো। হয়তোবা সে ভেবেছিলো ভাবীর মনটা তার জন্য একটু হলেও কাঁদবে । কিন্তু না তখনও গলেনি তার পাষাণী হৃদয়। সে মোবাইল চোরের বিচার ছাত্রদেরকেই করতে বলেছিলো এবং এটাও বলেছিলো যে, তাকে যেন এ ব্যাপারে আর ফোন দেয়া না হয়। এই বলে রাতে ফোনটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলো তার ভাবী। এর বাইরেও তোফাজ্জলের মনে লুকানো ছিল না বলা অনেক চাপা কান্না। সে কথা হয়ত কেউ নাইবা জানুক কিন্তু এখন সেই ভাবীই আবার তোফাজ্জলের অভিভাবক সাজতে চান কিভাবে।

 

জানাযায়,তোফাজ্জেলের মৃত্যুর পরে একমাত্র গার্ডিয়ান হিসেবে দাঁড়িয়েছে তার সেই ভাবী। যে নাকি তোফাজ্জলের জীবদ্দশায় তাকে দু’চোখে দেখতেই পারতনা। তার চলে যাবার পর তার সম্পদ-সম্পত্তির লোভে এখন সে অভিভাবক সেজে মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। কান্নার অভিনয় করছে। সব ধরনের  সাহায্য সহোযোগিতা  নিচ্ছে।

 

তাই এ নিয়ে সচেতন দেশবাসীর কাছে তার ওই নিকট আত্মীয়ের একটাই প্রশ্ন সে কোন অধিকারে নিচ্ছে ? যে তোফাজ্জেল জীবিত অবস্থা তার থেকে একটু ভালোবাসা পায় নাই।  তাই,দয়া করে কোন মিডিয়া পারসোন বা কোন সংস্থা তোফাজ্জেলের মৃত্যুর ব্যাপারে তার ভাবীকে কোন কাজে না লাগানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

 

তিনি বলেন, তোফাজ্জেল আর ফিরে আসবে না। সুতরাং ওর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ বাবদ, কোন সাহায্য সহোযোগিতা, ওর ভাবী বা আমরা আত্মীয় স্বজন যারা আছি  কারোরই দরকার নাই। তার দাবি ওর প্রতি এই নির্মমতা বা নিষ্ঠুরতা দেখে মায়ায় জড়িয়ে কেউ যদি কিছু করতে চান তাহলে ওর উদ্দেশ্য করে  মসজিদে মিলাদ পরিয়ে দিয়েন। যাতে করে শান্তি পায়  তোফাজ্জেলের বিদেহী  আত্মার ।

 

তিনি বলেন, এরকম হাজারো অসহায় তোফাজ্জেল এ দেশের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় একপেট ভাতের জন্য, এটা তাদের পিছনে ব্যয় করার অনুরোধ তার। তবে পরিশেষে আমরা এতটুকুই বলতে চাই যে, তোফাজ্জলদের করুণ কাহিনি এদেশে আর যেন ফিরে না আসে। সেটাই কাম্য।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *