রংপুরে উন্নয়নের নামে কাগুজে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা লুট  

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন
Advertisement

হারুন-অর-রশিদ বাবু, রংপুর:

রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় উন্নয়নের নামে  কাগুজে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।রংপুরের পীরগাছায় কাগজে-কলমে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই! বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হক সুমন, উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামীলীগের ছত্রছায়ায় থেকে তারা এসব উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ফলে উন্নয়নের নামে প্রতারণার শিকার হয়েছেন পীরগাছাবাসী।

ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুল হক বলেন, ‘গণশৌচাগার, রাস্তা, সিসি ক্যামেরা—সবকিছুর টাকাই গেছে অসাধু ব্যক্তিদের পকেটে। আমরা কোনো সুবিধা পেলাম না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পীরগাছা উপজেলা পরিষদের রেজুলেশনে পারুল ইউনিয়নের দক্ষিণ দেউতি নুরির বাড়ির সামনে কালীমন্দির মোড়ে, সুন্দর পাকা রাস্তা সংলগ্ন শামসুল মেকারের বাড়ীর সামনের মোড়ে ও পশ্চিম মনুচ্ছড়ায় সেকেন্দারের দোকানের সামনের মোড়ে জনসাধারণের ব্যাবহারের জন্য তিনটি স্থানে গণশৌচাগার নির্মাণের জন্য ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব শৌচাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই!

ইটাকুমারি ইউনিয়ন পরিষদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য ১ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ টাকা ব্যয়ে আইপিএস, মনিটর ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে শুধু ছয়টি ক্যামেরা এসেছে, যা এখনো কার্টুনবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, এগুলো যে কোনো সময় বিক্রি হয়ে যেতে পারে। কল্যাণী ইউনিয়ন পরিষদের সামনের পুকুর কেন্দ্রিক একাধিক প্রকল্প দেখানো হলেও বাস্তবায়ন নেই। এছাড়াও নব্দীগঞ্জ বাজারে সেড ঘর, সড়ক নির্মাণের নামেও প্রকল্প লুটের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারি প্রকল্পের নামে শুধু টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। আমরা কিছুই পাইনি!’

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের টাকায় জনগণের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন না করে কিছু ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের জন্য ‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। মহিষমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ১০০ মিটার কাঁচা রাস্তা রেখে ছাত্রলীগ নেতা আল নাহিয়ান অভির বাড়ির উঠান পর্যন্ত পাকা রাস্তা করা হয়েছে! অথচ দুই পাশের রাস্তা কাঁচা রয়ে গেছে।

ছাওলা ইউনিয়নের আদম গ্রামের সবুজ পাড়ায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগারের সভাপতির বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে ১৫০ ফুট রাস্তা পাকা করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ইউএনওর বিভিন্ন দুর্নীতির খবর যাতে বাইরে না যায়, সে জন্যই এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

কল্যাণী ইউনিয়নের তরণীর ভিটা কবরস্থান ও তৈয়ব মৌজার বালাচাটা হাফিজিয়া মাদ্রাসার নামে প্রকল্প বরাদ্দ দেখানো হলেও, বাস্তবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই! ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহীন মির্জা সুমন আমাদের কন্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বালাচাটা হাফিজিয়া মাদ্রাসা বলে কিছু নেই! তাহলে এই টাকার গন্তব্য কোথায়?’ জুলাই বিপ্লবের পর অনুপস্থিত থাকার কারণে পীরগাছায় দুই ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও, অজ্ঞাত কারণে ইটাকুমারি ও পারুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পলাতক থাকার পরেও জনসেবা নিশ্চিত করতে প্রশাসক নিয়োগের কোন খবর নেই। অথচ এই দুই ইউনিয়নে জনদূর্ভোগ চরমে উঠেছে।

এ ব্যাপারে পারুল ইউনিয়ন পরিষদ সচিব ফুলবাবু মিয়া আমাদের কন্ঠকে বলেন, চেয়ারম্যানের উপস্থিত-অনুপস্থিতের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। কারণ উর্ধতন কর্মকর্তাই বিষয়টি জানেন।

সাধারণ মানুষের প্রশ্ন চেয়ারম্যান যদি অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তার নিয়মিত কাজের কাগজ-পত্রে কে স্বাক্ষর করেন এবং উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্নয় সভায় কে অংশ গ্রহন করেন। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মদদপুষ্ট হওয়ায় প্রকাশ্যে অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নাজমুল হক সুমন পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর থেকে সরকারি পরিপত্র ও আদালতের আদেশ অমান্য করে তৎকালীন সরকার দলীয় নেতাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন। এমনকি নিজে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরেও পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন তিনি।

শুধু তাই নয়, বিগত সরকারের সময় দলীয় প্রকল্পের নামে, সরকারি অর্থ আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়ে তিনি নিজেও ফায়দা লুটিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলীয় প্রকল্পের নামে কল্যাণী ইউনিয়নের তরণীর ভিটায়, রাস্তার সিসি ঢালাই বাবদ আড়াই লাখ টাকার প্রকল্পে, মাত্র এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তছলিম উদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন, সাবেক পিআইও আব্দুল আজিজ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কল্যাণী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক।

স্থানীয়দের ভাষ্য, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষবাণিজ্য ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্পের পুরো টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুস ছালাম বলেন, ‘ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও ইউএনও মিলে কোটি কোটি টাকা মেরে খেয়েছে। এসব দুর্নীতির তদন্ত পূর্বক বিচার করতে হবে। উপজেলার বড়দরগাহ বাজার টু নব্দীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত  “শহীদ ফ্লাইট লে.কর্নেল রবিউল ইসলাম বুলেট স্মৃতি সড়ক” নির্মাণের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে এই কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। অবিলম্বে দুর্নীতির তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা। একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, ‘সরকার কি এসব দেখেও নীরব থাকবে? জনগণের টাকা লুটকারীদের কি বিচার হবে না।

কল্যাণীর তালতলা হইতে চওড়া পাড়া পর্যন্ত এলজিইডির ২৫০০+ মিটার সড়ক সংস্কারের কাজে, রাস্তায় পুর্বের ব্যবহৃত ইট খোয়া চুরির সত্যতা মিলেছে। স্বচাষ গ্রামের, শফিকুল ইসলাম, দুলাল মিয়া, শহীদুল ইসলাম, বাবু লাল সহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, এলজিইডি পীরগাছা এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. ফরহাদ হোসেন ও ঠিকদার রাঙ্গার  যোগসাজশে স্থানীয় সাব ঠিকাদার মন্তাজুর রহমান রাস্তার ইট ও খোয়া চুরি করে কাকড়া যোগে ঠিকাদার রাঙ্গার বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং কিছু খোয়া নিজ বাড়িতেও লুকিয়ে রাখে।

এ বিষয়ে  জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী (অ:দা:) মো: আসাদুজ্জামান জেমি মালামাল চুরির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রাস্তার মালামাল চুরির অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই এবং চোরাইকৃত মালামালের কিছু অংশ সাব ঠিকাদার মন্তাজের বাড়ি থেকে উদ্ধার করি। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ করা হয়েছে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।

উপজেলা কতৃক বরাদ্দকৃত প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ তশ্রুপের বিষয়ে জানতে চাইলে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন বলেন, উপজেলায় কোন অনিয়ম হয়নি সকল প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।  তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গণশৌচাগারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, ইউএনও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর নিকট হতে তথ্য নিতে বলেন। এবং অন্য কোন বিষয়ে কথা বলতে রাজী হননি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সানোয়ার মোরশেদ বলেন, ওই গণশৌচাগার আমার দপ্তরের কাজ না। নির্বাহী অফিসার স্যার কেন আমার কথা বলেছেন সেটা তিনি ভালো জানেন।

এ বিষয়ে জানতে রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সালকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি বলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ধারাবাহিক প্রতিবেদনের- প্রথম পর্ব। 

 

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Advertisement
Advertisement